‘ছি ছি করে সমাজ, অথচ ইজ্জত দিয়ে দেশ স্বাধীন করলাম
মাত্র দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল ফিরোজা বেগমের। গ্রাম থেকে বেশ দূরে, মাদারীপুরের তরকীতে ছিল শ্বশুরবাড়ি। স্বামী চাষবাস করতেন। বিলের ধারের বাড়িতে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই কাটছিল তাদের দিন। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তাদের কোলজুড়ে আসে প্রথম সন্তান। কিন্তু একাত্তরের কালরাত্রি সেই সুখ সইবে কেন?
ফিরোজা বেগমের জবানিতেই উঠে আসে সেই সুখস্মৃতি ও তার করুণ পরিণতির কথা, “স্বাধীনের আগেই একটা পোলা হইছিল। স্বামী-সন্তান নিয়া সুখেই দিন কাটত। দেশে যহন যুদ্ধ হয় তহন কোলের ছেলেডার বয়স ৬ মাস। গুটি গুটি পায়ে হাঁটে। আমারও প্রাণ জুড়ায়া যায়।”
কিন্তু যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে শুরু করে। জীবন বাঁচাতে মানুষ দিগ্বিদিক পালাতে থাকে। ফিরোজা বেগমের বাড়িতেও আগুন দেয় তারা। প্রথমে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলেও, পরে মিলিটারির আসার খবরে মামাবাড়ির দিকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন তারা। আর ঠিক তখনই যমদূতের মতো হাজির হয় পাকিস্তানি সেনা। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থেকেও শেষ রক্ষা হয়নি। কোলের ছয় মাসের শিশুটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় নরপিশাচদের কাছে।
ফিরোজা বেগম বলেন, “ওরা আইসা প্রথম কোল থিকা ওরে ছাড়াইয়া নেয়। ভয়ে ও চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে। ওরা নিয়াই দুইজন হাত দিয়া টাইনাই ছিঁইড়া ফালাইছে আমার পোলাডারে। এরপর তারে মেলা মাইরা ফেলাইয়া দিছে। ওর তখন আর দম নাই। কান্নার শব্দও নাই। রক্তাক্ত ও নিথর শরীরডা পইরা ছিল মাটিতে। আর সহ্য করতে পারলাম না। একটা চিল্লানি দিয়া উঠলাম আমি। চোখের সামনে এভাবেই কোলের পোলাডারে পাক বাহিনী মাইরা ফালায়। ওই শিশুডার কি দোষ ছিল বলেন? পাকিস্তানিরা না মুসলমান? কোলের পোলাডারে যে ওরা মারলো এইডা কি ধর্মে আছে? এই বিচার আল্লাহর কাছে দিয়া রাখছি ভাই।”
মাদারীপুরের হযরতপুর গ্রামের মোতালেব গোড়ামী আর মরিয়ম বেগমের বড় সন্তান ফিরোজা। একাত্তরের সেই বিভীষিকাময় দিনে চোখের সামনে কোলের সন্তানকে হত্যার পর ফিরোজার ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। সেই নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে শিউরে ওঠেন তিনি।
“বাচ্চাডারে মারছে ওরা। আমাকে ‘আ’ করতেও দেয় নাই। একজন বুকের ওপর পাড়া দিছে। আরেকজন মুখে গামছা ভরে দিছে। আমি ‘আ’ কইরা চিইক্করও দিতে পারি নাই! বাবারে বইলাই পাগলের মতো হয়ে যাই। এরপরই জ্ঞান হারাইছি। যহন জ্ঞান হইল দেখলাম চোখ বান্ধা। কই লইয়া আইছে টের পাই নাই। চোখ খোলার পর দেখলাম অনেকগুলা মেয়েমানুষ। কয়েকজন বয়স্কও আছে। তারপর আটকা রইলাম অনেক দিন। অনেক হেস্তনেস্ত করল। কানতে কানতে বুক ভাসাইলাম। তবুও শরীরডার ওপর নির্যাতন চলল।”

Comments
Post a Comment